শারীরিক ফিটনেস নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই, তাই না? ব্যায়ামাগারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরানো, ডায়েট মেনে চলা – এই সবই আমরা করি একটা সুন্দর, সুঠাম শরীরের জন্য।
কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, শুধু সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করাই যথেষ্ট? নাকি ভেতরের শক্তি, মানে শক্তিশালী কোর বেশি জরুরি?
আসুন, আজ আমরা এই নিয়েই আলোচনা করি।
Contents
- শক্তিশালী কোর বনাম সিক্স-প্যাক অ্যাবস: কোনটা বেশি জরুরি এবং কেন?
- কেন শক্তিশালী কোর বেশি জরুরি?
- সিক্স-প্যাক অ্যাবস কি জরুরি নয়?
- কীভাবে শক্তিশালী কোর তৈরি করবেন?
- ডায়েট কেমন হওয়া উচিত?
- কিছু সাধারণ ভুল যা এড়িয়ে চলা উচিত
- অনুপ্রেরণা ধরে রাখুন
- গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় (Key Takeaways)
- কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
শক্তিশালী কোর বনাম সিক্স-প্যাক অ্যাবস: কোনটা বেশি জরুরি এবং কেন?
আপনি যদি ফিটনেস জার্নি শুরু করতে চান, তাহলে এই প্রশ্নটা আপনার মনে আসা স্বাভাবিক। সিক্স-প্যাক অ্যাবস দেখতে দারুণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু শক্তিশালী কোরের গুরুত্ব শুধু সৌন্দর্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
কোর মাসল আসলে কী?
কোর মাসল বলতে আমাদের পেটের ভেতরের দিকের মাংসপেশিগুলোকে বোঝায়। শুধু পেটের সামনের দিকের নয়, পেছনের দিকের মাংসপেশি, যেমন স্পাইনাল ইরাক্টরসও এর অন্তর্ভুক্ত।
কোর মাসলের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
- ট্রান্সভার্স অ্যাবডোমিনিস (Transverse Abdominis)
- রেকটাস অ্যাবডোমিনিস (Rectus Abdominis)
- অব্লিকস (Obliques)
- মাল্টিফিডাস (Multifidus)
কোর মাসলের কাজ কী?
কোর মাসলের প্রধান কাজগুলো হলো:
- মেরুদণ্ডকে স্থিতিশীল রাখা।
- শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা।
- বিভিন্ন মুভমেন্টে সাহায্য করা।
সিক্স-প্যাক অ্যাবস কী?
সিক্স-প্যাক অ্যাবস হলো রেকটাস অ্যাবডোমিনিস (Rectus Abdominis) নামক পেটের মাংসপেশি। এই পেশিটি দেখতে ছয়টি খণ্ডের মতো, তাই একে সিক্স-প্যাক অ্যাবস বলা হয়।
সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করতে হলে শরীরের ফ্যাট কমাতে হয় এবং পেটের এই বিশেষ পেশিটির ব্যায়াম করতে হয়।
কেন শক্তিশালী কোর বেশি জরুরি?
সিক্স-প্যাক অ্যাবস দেখতে হয়তো খুব আকর্ষণীয়, কিন্তু শক্তিশালী কোরের উপকারিতা অনেক বেশি। আসুন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জেনে নেই:
শারীরিক স্থিতিশীলতা এবং ভারসাম্য
শক্তিশালী কোর আপনার শরীরকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। আপনি যখন হাঁটাচলা করেন, দৌড়ান বা অন্য কোনো কাজ করেন, তখন আপনার কোরের পেশিগুলো মেরুদণ্ডকে সোজা রাখে এবং ভারসাম্য বজায় রাখে।
ফলে, পড়ে যাওয়ার বা আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
কোমর ব্যথার উপশম
কোমর ব্যথার একটি প্রধান কারণ হলো দুর্বল কোর মাসল। শক্তিশালী কোর মাসল আপনার মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেয় এবং কোমরের ওপর চাপ কমায়।
নিয়মিত কোর মাসলের ব্যায়াম করলে কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ভালো বসার ভঙ্গি
আপনার বসার ভঙ্গি (posture) ভালো রাখার জন্য শক্তিশালী কোরের বিকল্প নেই।
কোর মাসল দুর্বল হলে আপনি কুঁজো হয়ে বসতে পারেন, যা মেরুদণ্ডের জন্য ক্ষতিকর। শক্তিশালী কোর আপনাকে সোজা হয়ে বসতে সাহায্য করে।
ক্রীড়া এবং দৈনন্দিন জীবনে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি
ক্রীড়াবিদদের জন্য শক্তিশালী কোর খুবই জরুরি। এটি তাদের লাফানো, দৌড়ানো এবং শরীর ঘোরানোর মতো মুভমেন্টগুলোতে সাহায্য করে।
শুধু ক্রীড়াবিদ নয়, দৈনন্দিন জীবনেও শক্তিশালী কোর আপনাকে কর্মক্ষম রাখে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি
কোর মাসল আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। বিশেষ করে ট্রান্সভার্স অ্যাবডোমিনিস নামক পেশিটি শ্বাস ছাড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শক্তিশালী কোর থাকলে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস আরও গভীর এবং কার্যকর হবে।

সিক্স-প্যাক অ্যাবস কি জরুরি নয়?
বিষয়টা এমন নয় যে সিক্স-প্যাক অ্যাবস জরুরি নয়। এটি অবশ্যই একটি ভালো শারীরিক লক্ষ্যের অংশ হতে পারে।
তবে, সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করতে গিয়ে যদি আপনি শুধু পেটের ব্যায়াম করেন এবং কোরের অন্যান্য পেশিগুলোর দিকে মনোযোগ না দেন, তাহলে তা শরীরের জন্য ভালো নাও হতে পারে।
সিক্স-প্যাক অ্যাবসের পথে যা মনে রাখতে হবে
- সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করতে হলে সঠিক ডায়েট এবং ব্যায়ামের সমন্বয় দরকার।
- শরীরের ফ্যাট না কমালে অ্যাবস দৃশ্যমান হবে না।
- অতিরিক্ত ব্যায়াম শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
| বিষয় | শক্তিশালী কোর | সিক্স-প্যাক অ্যাবস |
|---|---|---|
| গুরুত্ব | শারীরিক স্থিতিশীলতা, কোমর ব্যথা উপশম, ভালো বসার ভঙ্গি, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি | শারীরিক সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি |
| উপকারিতা | মেরুদণ্ডকে সুরক্ষা দেয়, ভারসাম্য রক্ষা করে, দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করে | আকর্ষণীয় চেহারা, ফ্যাশন সচেতনতা |
| প্রয়োজনীয়তা | শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় | শারীরিক লক্ষ্যের অংশ হতে পারে |
| ব্যায়াম | প্ল্যাঙ্ক, ব্রিজ, বার্ড-ডগ | ক্রাঞ্চেস, লেগ রেইজেস |
| ডায়েট | সুষম খাবার, প্রোটিন, ফাইবার | ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ, ফ্যাট কমানো |
কীভাবে শক্তিশালী কোর তৈরি করবেন?
শক্তিশালী কোর তৈরি করার জন্য কিছু কার্যকরী ব্যায়াম নিচে দেওয়া হলো:
প্ল্যাঙ্ক (Plank)
প্ল্যাঙ্ক একটি অসাধারণ ব্যায়াম, যা আপনার কোরের প্রায় সব পেশিকে শক্তিশালী করে।
- প্রথমে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন।
- এরপর হাতের তালু এবং পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে শরীরকে মাটি থেকে উপরে তুলুন।
- আপনার শরীর যেন একটি সরলরেখায় থাকে।
- ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট এই অবস্থায় থাকুন।
ব্রিজ (Bridge)
ব্রিজ ব্যায়ামটি আপনার কোমর এবং পেটের পেশিগুলোর জন্য খুবই উপকারী।
- প্রথমে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন।
- এরপর হাঁটু ভাঁজ করে পায়ের পাতা মাটিতে রাখুন।
- কোমর মাটি থেকে উপরে তুলুন।
- কয়েক সেকেন্ড এই অবস্থায় থাকুন এবং ধীরে ধীরে কোমর নিচে নামান।
বার্ড-ডগ (Bird-dog)
বার্ড-ডগ ব্যায়ামটি আপনার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং কোরকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
- প্রথমে হাত এবং হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসুন।
- এরপর ডান হাত এবং বাঁ পা একসঙ্গে উপরে তুলুন।
- কয়েক সেকেন্ড এই অবস্থায় থাকুন এবং ধীরে ধীরে হাত ও পা নিচে নামান।
- অন্য দিকেও একই ভাবে করুন।

অন্যান্য ব্যায়াম
উপরের ব্যায়ামগুলো ছাড়াও আরও কিছু ব্যায়াম আছে, যা আপনার কোরকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে:
- সাইড প্ল্যাঙ্ক (Side Plank)
- রাশিয়ান টুইস্ট (Russian Twist)
- লেগ রেইজেস (Leg Raises)
ডায়েট কেমন হওয়া উচিত?
ব্যায়ামের পাশাপাশি সঠিক ডায়েটও খুব জরুরি। শক্তিশালী কোর এবং সিক্স-প্যাক অ্যাবস উভয়ের জন্যই স্বাস্থ্যকর খাবার প্রয়োজন।
প্রোটিন
প্রোটিন পেশি গঠনে সাহায্য করে। তাই আপনার ডায়েটে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন থাকা উচিত। ডিম, চিকেন, মাছ, ডাল এবং বাদাম প্রোটিনের ভালো উৎস।
ফাইবার
ফাইবার হজমক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং পেট ভরা রাখে। ফল, সবজি এবং শস্যজাতীয় খাবারে প্রচুর ফাইবার পাওয়া যায়।
কম ফ্যাটযুক্ত খাবার
অতিরিক্ত ফ্যাট শরীরে জমা হয় এবং অ্যাবস দৃশ্যমান হতে দেয় না। তাই কম ফ্যাটযুক্ত খাবার খান এবং ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।
পর্যাপ্ত জল
শরীরকে সতেজ রাখার জন্য প্রচুর জল পান করা জরুরি। এটি হজমক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।
কিছু সাধারণ ভুল যা এড়িয়ে চলা উচিত
ব্যায়াম করার সময় কিছু ভুল আমরা প্রায়ই করে থাকি। এই ভুলগুলো এড়িয়ে চললে আপনি ভালো ফল পাবেন।
বেশি ব্যায়াম করা
অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে শরীরের ওপর চাপ পড়ে এবং ইনজুরির ঝুঁকি বাড়ে। ধীরে ধীরে ব্যায়ামের পরিমাণ বাড়ান।

ভুল ভঙ্গিতে ব্যায়াম করা
ভুল ভঙ্গিতে ব্যায়াম করলে পেশিতে চোট লাগতে পারে। সঠিক ভঙ্গি জেনে ব্যায়াম করুন। প্রয়োজনে প্রশিক্ষকের সাহায্য নিন।
শুধু পেটের ব্যায়াম করা
শুধু পেটের ব্যায়াম করলে কোরের অন্যান্য পেশি দুর্বল থেকে যায়। পুরো কোরের জন্য ব্যায়াম করুন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেওয়া
পেশি পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি।
অনুপ্রেরণা ধরে রাখুন
ফিটনেস জার্নিটা সহজ নয়। অনেক সময় ধৈর্য হারাতে পারেন। কিন্তু মনে রাখবেন, ধারাবাহিকতা সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
লক্ষ্য স্থির করুন
নিজের জন্য একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য স্থির করুন। ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে আপনি অনুপ্রাণিত থাকবেন।
নিজের অগ্রগতি ট্র্যাক করুন
নিজের অগ্রগতি নিয়মিত ট্র্যাক করুন। এতে আপনি বুঝতে পারবেন কতটা উন্নতি করছেন এবং কোন দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন
ফিটনেস ভালোবাসেন এমন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। তাদের থেকে আপনি অনুপ্রেরণা পাবেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারবেন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় (Key Takeaways)
- শক্তিশালী কোর সিক্স-প্যাক অ্যাবসের চেয়ে বেশি জরুরি।
- কোর মাসল শারীরিক স্থিতিশীলতা, ভারসাম্য এবং কোমর ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত প্ল্যাঙ্ক, ব্রিজ এবং বার্ড-ডগের মতো ব্যায়াম করুন।
- সুষম ডায়েট এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীরকে সুস্থ রাখতে অপরিহার্য।
- অনুপ্রেরণা ধরে রাখতে নিজের অগ্রগতি ট্র্যাক করুন এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে:
১. সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করতে কত দিন লাগে?
সিক্স-প্যাক অ্যাবস তৈরি করার সময়টা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এটা নির্ভর করে আপনার শরীরের ফ্যাট লেভেল, ডায়েট এবং ব্যায়ামের ওপর। সাধারণত, কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
২. শুধু ক্রাঞ্চেস (Crunches) করলেই কি সিক্স-প্যাক অ্যাবস হবে?
না, শুধু ক্রাঞ্চেস করলে সিক্স-প্যাক অ্যাবস হবে না। এর জন্য আপনাকে সঠিক ডায়েট এবং কার্ডিও ব্যায়ামের সঙ্গে পেটের অন্যান্য ব্যায়ামও করতে হবে।
৩. কোমর ব্যথার জন্য কোন ব্যায়ামগুলো ভালো?
কোমর ব্যথার জন্য প্ল্যাঙ্ক, ব্রিজ এবং বার্ড-ডগের মতো ব্যায়ামগুলো খুবই উপকারী। এগুলো আপনার কোরের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে এবং মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেয়।
৪. গর্ভবতী মহিলারা কি কোরের ব্যায়াম করতে পারবেন?
গর্ভবতী মহিলারা অবশ্যই কোরের ব্যায়াম করতে পারবেন, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। কিছু বিশেষ ব্যায়াম আছে, যা এই সময় নিরাপদ।
৫. ডায়েটে কী কী খাবার যোগ করা উচিত?
ডায়েটে প্রোটিন, ফাইবার এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যোগ করা উচিত। ডিম, চিকেন, মাছ, ডাল, ফল, সবজি এবং বাদাম আপনার শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
তাহলে, আপনি বুঝতেই পারছেন, শুধু সুন্দর দেখতে অ্যাবস তৈরি করাই যথেষ্ট নয়। শক্তিশালী কোর আপনার শরীরের জন্য অনেক বেশি জরুরি।
আজ থেকেই কোরের ব্যায়াম শুরু করুন এবং সুস্থ থাকুন। আপনার ফিটনেস যাত্রা শুভ হোক!
যদি এই বিষয়ে আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা সবসময় আপনার পাশে আছি।